গ্যাসের চুলা থেকে যে পরিমাণ নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (NO2) ছড়ায়, তা মানব স্বাস্থ্যের সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। গ্যাসের চুলা ব্যবহারের ফলে শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হাঁপানির মতো রোগ হতে পারে। এই গ্যাসের চুলার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অশ্বেতাঙ্গ এবং নিম্ন আয়ের মানুষেরা অসমভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেসে’ গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত এক নতুন গবেষণাপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাসাবাড়ির ভেতর গ্যাসের চুলা ও প্রোপেন অ্যাপ্লায়েন্স ব্যবহারের ফলে বাতাসে ক্ষতিকারক নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘর ও বাইর—উভয়ের জন্য বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ৭৫ শতাংশ।
ফলে কোনো ব্যক্তি যদি বাইরের ট্র্যাফিক জ্যামে দূষণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র বা অন্য কোনো উৎসের নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড এড়িয়ে চলেন, এরপরও গ্যাসের চুলায় রান্না করার কারণে তিনি শুধু বাড়িতেই ৭৫ শতাংশ দূষিত বাতাসের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেবেন।
গবেষণার মূল লেখক এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী ইয়ানাই কাশতান বলেছেন, ‘আপনি গ্যাসের চুলা ব্যবহার করছেন মানে আপনি সরাসরি বাড়িতে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছেন। রান্নাঘরের জানালা গ্যাস বেরিয়ে যেতে সাহায্য করে, কিন্তু সেটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। সর্বোত্তম উপায় হলো এই গ্যাসের দূষণ কমানো।’
নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড শ্বাসনালিকে জ্বালিয়ে দেয় এবং হাঁপানির মতো অসুস্থতা বাড়াতে পারে। স্ট্যানফোর্ডের ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গ্যাসের চুলা থেকে দীর্ঘ মেয়াদে উদ্গীরণ হওয়া নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের কারণে প্রতিবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ৫০ হাজার শিশুর হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়।
গবেষকেরা গ্যাসের চুলা ব্যবহারের পূর্বে, চলাকালে এবং পরে ১০০টিরও বেশি বাড়িতে NO2 পরিমাপ করেছেন। এতে দেখা গেছে, চুলা চালু হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে দূষণ শয়নকক্ষে চলে যায় এবং ব্যবহারের কয়েক ঘণ্টা পরও বাতাসে NO2-এর পরিমাণ বিপজ্জনক মাত্রার ওপরে থাকে।
স্ট্যানফোর্ডের আর্থ সিস্টেম সায়েন্সের অধ্যাপক এবং গবেষণার সহলেখক রব জ্যাকসন বলেন, ‘এই গ্যাস পুরো বাড়িতে অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা আমাদের ধারণার চেয়ে বেশি। শুধু একবার রান্নার ফলাফল বিবেচনা করলে হবে না। আপনি ভেবে দেখেন, সকালের নাশতা , দুপুরের খাবার ও রাতের খাবারের জন্য কয়বার গ্যাসের চুলা জ্বালানো হচ্ছে আপনার বাসায়। এটি চলছে সপ্তাহ, মাস ও বছরজুড়ে।’
এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩৮ শতাংশ পরিবার গ্যাসের চুলা ব্যবহার করে। তবে তাদের সবাই সমানভাবে NO2 গ্যাসের শিকার হয় না।
সমীক্ষায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, বাড়ির আকার এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ৮০০ বর্গফুটের কম প্রশস্ত বাসা বা ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা ৩ হাজার বর্গফুটের বাড়ির বাসিন্দাদের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্ষতির শিকার হয়।
কলোরাডো স্কুল অব পাবলিক হেলথের পরিবেশগত এবং পেশাগত স্বাস্থ্যের অধ্যাপক জন সামেট বলেছেন, পুরোনো বাড়িগুলো ছোট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং সেগুলোতে প্রায়ই গ্যাসের চুলা থাকে। এই গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আমাদের বাড়ির অভ্যন্তরীণ বাতাসের দিকে মনোযোগ দেয়, যেখানে আমরা বেশির ভাগ সময় থাকি।’
গবেষণার ফলাফলে জাতিগত এবং আর্থ-সামাজিক অসমতার কারণে এই গ্যাসের ক্ষতির শিকার হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমেরিকান ভারতীয় এবং আলাস্কার আদিবাসীরা ৬০ শতাংশ বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। অপর দিকে কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো বা হিস্পানিক পরিবারগুলো গ্যাসের চুলা থেকে ২০ শতাংশ বেশি NO2 গ্যাসের শিকার হয়েছেন।
বছরে ১০ হাজার ডলারের কম উপার্জনকারী পরিবারের সদস্যরা ১৫০ হাজার ডলারের বেশি উপার্জনকারী পরিবারের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি হারে NO2 গ্যাসের শিকার হচ্ছে।
জ্যাকসন বলেন, দরিদ্ররা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কারণ, তারা যেসব এলাকায় থাকে, সেখানে বাইরের বাতাস খারাপ এবং নানা কারণে ঘরের ভেতরের বাতাস আরও খারাপ। যেহেতু নিম্ন আয়ের মানুষ এবং অশ্বেতাঙ্গরা হাইওয়ে, বন্দর, শিল্প এলাকার আশপাশ এবং অন্যান্য দূষণীয় এলাকায় থাকে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ডায়ানা হার্নান্দেজ বলেছেন, ‘আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে, লোকেরা কেবল রান্না করতেই চুলা ব্যবহার করে। হার্নান্দেজের দলের পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০ শতাংশেরও বেশি নিউইয়র্কবাসী তাদের ঘর গরম করার জন্য চুলা বা ওভেন ব্যবহার করে। যেখান থেকে শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেন নির্গত হয়।’
সূত্র: আজকের পত্রিকা ডট কম