নিজস্ব প্রতিবেদক,মোঃ জালাল উদ্দিন
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আলোচিত স্কুল ছাত্র ফাহাদ রহমান মারজান এর মৃত্যু ১০ দিন পেড়িয়ে গেলেও মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। এনিয়ে নিহত এসএসসি পরিক্ষার্থী ফাহাদের পরিবার শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে কে বা কারা তাকে হত্যা করে রেল লাইনে ফেলে রেখে দুর্ঘটনা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।
উপজেলার পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার বাসিন্দা শ্রীমঙ্গল সাব রেজিষ্ট্রার অফিসের দলিল লিখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ ফজলুর রহমান এর পুত্র ফাহাদ (১৭) শহরের শাহ মোস্তফা জামেয়া ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে এবছর এসএসসি পরিক্ষার্থী ছিল। গত ১২ অক্টোবর সকাল ৬টার সময় শাহীবাগ এলাকার রেল লাইনের পাশ থেকে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে জিআরপি পুলিশ।
ফাহাদ এর পিতা ফজলুর রহমান অভিযোগ করেন, তার ছেলেকে কে বা কারা পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে থাকতে পারে। শুরু থেকে জিআরপি পুলিশের ভূমিকা ছিল দায়সারা। মরদেহ পোস্ট মোর্টেম পাঠানোর সময় রেলওয়ে পুলিশের এসআই (তদন্ত কর্মকর্তা) মোল্লা সেলিমুজ্জামান ’ফাহাদ আগের দিন থেকে নিখোঁজ রয়েছে’ এবং ‘ট্রেনে কাটা পড়েছে’ মর্মে একটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়ার জন্য পীড়পিড়ি করলেও আমি স্বাক্ষর করিনি’। তিনি বলেন, সেই দিনের রেলওয়ে প্লাফরম ও আশেপাশের সিসি টিভি ফুটেজ উদ্ধারে কোন অগ্রগতি নেই।
তাদের প্রতি আস্থাহীনতার কারনে আমরা চাই এই তদন্তভার পিবিআই, র্যাব বা সিআইডির মতো কোন সংস্থার হাতে দেয়ার দাবী করেন ফজলুর রহমান।
এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহতের সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে মাথার বাম পাশে ৬ বাই ২ ইঞ্চি একাধিক কাটা জখম, কপালে ৩ বাই ১ ইঞ্চি কাটা জখম, পিঠে ২ বাই ৩ ইঞ্চি ছেছড়া দাগ এবং বাম পায়ের হাটুঁর নিচে হালকা ও বৃদ্ধা আঙ্গুলে কাটা দাগ রয়েছে। এতে দেহের বাকি সব অংশ স্বাভাবিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল রেল স্টেশন এলাকার কয়েক ব্যক্তির সাথে কথা বলে সুরতহাল রিপোর্ট মতে তারা এটাকে ট্রেনের আঘাতে ফাহাদের মৃত্যু হওয়ার সম্ভবনা উঁড়িয়ে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, মাথায় যে আঘাতের কথা বলা হয়েছে- সাধারণ ক্ষেত্রে ট্রেনে আঘাতে মাথা চুর্ণবিচুর্ণ হওয়ার কথা।
জিআরপি পুলিশের তদন্তে অনাস্থার কারন হিসেবে ফাহাদের পিতা ফজলুর রহমান জানান, ফাহাদ মুত্যৃর ৪ দিন আগে তার ফোনে অজ্ঞাত একটি মোবাইল ফোন থেকে দুই দফা ফোন আসে। কল দুটি রিসিভ করেন ফাহাদের মা। এসময় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ‘ফাহাদকে বাহিরে না যেতে’ সতর্ক করেন। কে এই ব্যক্তি? যিনি ফাহাদের বিপদের আশংকা করেছিল? তাকে সনাক্তসহ ফাহাদের মোবাইল কললিষ্ট যাচাই করার দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার আজমান মিয়ার ছেলে বেকারী কর্মী হৃদয় নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, ঘটনার দিন অনুমানিক ভোর ৫ টার দিকে শহরের উকিল বাড়ি সড়কে ফাহাদকে অজ্ঞাত ৩ ব্যক্তির সাথে হেঁটে যেতে দেখে। পুর্ব পরিচিত হওয়ায় হৃদয় ফাহাদকে কোথায় যাচ্ছে-প্রশ্ন করলে সে বলে রেল স্টেশনে নাস্তা করতে যাচ্ছি। ফাহাদের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, সে কোন দিন এত ভোরে বাসা থেকে বের হয়না। এদিন তার এসএসসি’র ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল। ফলে কোন ভাবেই তার বাহিরে যাওয়ার কথা নয়। আমরাও জানতে পারিনি সে কখন বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে।
ফাহাদের স্কুলের সহপাঠী মাসুক ইসলাম মুন্না জানায়, ফাহাদের সাথে মুসলিমবাগ এলাকার একটি মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ফাহাদের দুর্ঘটনাস্থল শাহীবাগ রেল লাইন থেকে ওই মেয়েটির বাসা কাছাকাছি। মুন্নার আশংকা -এনিয়ে কোন ঝামেলা থাকতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- শাহীবাগ-মুসলিমবাগের রেল লাইন অংশের কিছু এলাকা মাদকসেবী ও কারবারিদের আখরা হিসেবে পরিচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার আরেক সহপাঠী জানায় তার মৃত্যুর ঘটনায় এই এলাকার মাদকসেবীদের কোন যোগসুত্র থাকতে পারে।
এদিকে, ওই ট্রেনের যাত্রী পরিচয়ে এক যুবক দাবী করেন, সে এই ট্রেনের ধাক্কায় এক ব্যক্তিকে আহত হয়ে লাইনের পাশে পড়ে থাকতে দেখেন। শ্রীমঙ্গল স্টেশনে নেমে ঘটনাস্থলে এসে স্থানীয়দের বিষয়টি জানায়। এসময় জনি নামে এক পরিবহন শ্রমিক ৯৯৯-এ ফোন দিলে ফায়ার সার্ভিস এর কর্মীরা এসে আহত ফাহাদকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। অজ্ঞাত ওই যাত্রী স্ব প্রনোদিত হয়ে আহত ফাহাদকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সাথে হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। সুরমা মেইল ট্রেনটি ঢাকা থেকে এলেও তিনি স্থানীয়দের জানায়, সে এই ট্রেনযোগে কুমিল্লা থেকে এসেছে। ফলে এই যুবকের এমন আচরনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সকাল অনুমানিক ৬ টা ৭ মিনিটে দুর্ঘটনাস্থল অতিক্রম করা ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী লোকাল ট্রেন সুরমা মেইল এর চালক জাহিদুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গলে রেল স্টেশন সামনে থাকায় ঘটনাস্থলে ট্রেনের গতি স্বাভাভিক ভাবে কমিয়ে আনা হয়। তিনি নিশ্চিত করে বলেন, সেখানে কোন ব্যক্তির সাথে ট্রেনের ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটেনি।
জিআরপির তদন্ত কর্মকর্তা মোল্লা সেলিমুজ্জামান জানান, পোষ্ট মোর্টেম প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। ফাহাদের পিতার অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, ফোনের কললিষ্ট (সিডিআর) এর অপেক্ষায় আছি। পোস্ট মোর্টেম প্রতিবেদন ও কললিস্ট হাতে এলে তদন্তকাজ এগিয়ে নেয়া যাবে বলে তিনি জানান।